একসময় কৃষি বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে খননকৃত যশোরের শার্শা উপজেলার উলাশীর খাল। প্রায় অর্ধশতক আগে শুরু হওয়া এই খাল খনন কর্মসূচি দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে রেখেছিল বিশাল অবদান। কিন্তু আজ সেই উলাশীর খাল নিজেই যেন ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যেতে বসেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মৃতপ্রায় এই খালটি আজও বহন করে চলেছে জিয়াউর রহমানের কৃষি স্বপ্নের স্মৃতি, যা এখন কেবলই স্থানীয়দের দীর্ঘশ্বাসের কারণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ও ঐতিহ্যবাহী দেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোরের শার্শা উপজেলার উলাশী ইউনিয়নে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে খননকৃত উলাশীর খাল, যা স্থানীয়ভাবে ‘জিয়া খাল’ নামেই পরিচিত। উলাশী ও রঘুনাথপুর গ্রামের মুখ থেকে শুরু হয়ে যদুনাথপুর গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত এই খালটি। পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর জিয়াউর রহমান নিজেই এই খাল খনন কাজ শুরু করেছিলেন।
শহীদ জিয়াউর রহমানের গৃহীত ১৯ দফা কর্মসূচির অন্যতম ছিল দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং দেশে কেউ যেন অভুক্ত না থাকে তা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে খাল খনন কর্মসূচি অসামান্য অবদান রাখে। প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা দেশে এই কর্মসূচি শুরু হয়, যা সমাজকে সংগঠিত করার এক অনন্য নজির স্থাপন করে।
এই কর্মসূচির বহুমুখী উদ্দেশ্য ছিল কৃষিতে সেচ নিশ্চিত করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সারা দেশে খাল খনন করে প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে উপরিভাগের পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং খালগুলোতে মাছের উৎপাদনও বাড়ে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত শহীদ জিয়াউর রহমান সারা দেশে ১৫০০-এর বেশি খাল খনন করেন, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিল কৃষিতে। কৃষকদের জন্য এটি অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের সেচ সুবিধা ছিল, ফলে তাদের অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় বহন করতে হয়নি। শুধু সেচের আওতা বৃদ্ধিই নয়, গ্রামীণ অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য সহায়তারও পথ খুলে দিয়েছিল খাল খনন কর্মসূচি। কার্যত, এটি ছিল একসঙ্গে অনেক সাফল্য অর্জনের একটি সুপরিকল্পিত কর্মসূচি।
আজ প্রায় সাড়ে চার দশক পরেও খাল খননের প্রয়োজনীয়তা সকলেই উপলব্ধি করছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একসময়ের ভরা যৌবনের সেই উলাশীর খাল আজ প্রায় মৃত খালে পরিণত হয়েছে। খাল পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের মাধ্যমে জানা যায়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খাল খননের সময় খাল পাড়ের একটি ভবনে রাত্রিযাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে সেখানে বিভিন্ন সময়ে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো এবং কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হতো। এমনকি বীজ সংরক্ষণাগারও ছিল সেখানে। সময়ের পরিক্রমায় ভবনটির সকল মালপত্র লুট করে এটিকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। উলাশী ইউনিয়নের এক সময়ের মেম্বার শরিফুল ইসলাম মিলন খাল খননের স্মৃতিফলকটিও পাশের খালে ফেলে দেন, যা পরে স্থানীয় সংবাদকর্মী মনিরুল ইসলাম মনি ও অন্যান্যরা উদ্ধার করে পুনরায় স্থাপন করেন। খাল পাড়ের পাশে খালি জায়গাটিতে শার্শা উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মণ্ডল ভূমিহীনদের জন্য আবাসন গড়ে তুলেছেন।
খাল পাড়ের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, খননের পর থেকে খালটি আজ পর্যন্ত সংস্কার করা হয়নি। অথচ এই খাল দিয়ে সোনামুখী ও বন মান্দার নামক দুটি বিলের হাজার হাজার বিঘা জমি জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পেত। ইরি মৌসুম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফসলের পানির সেচের চাহিদা পূরণ হতো এই খালের পানি দিয়ে। এই খালে মাছের উৎপাদনও ভালো ছিল। আজ তার কোনটিই নেই, সবকিছুই অতীত।
তিনি খালটির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বলেন, “একসময়ে খালের পানি দিয়ে আমি ফসলের জমিতে সেচের চাহিদা পূরণ করতাম। কিন্তু এখন খালে আগের মতো পানি নেই। খালটি এখন মৃতপ্রায়। যে কারণে বিকল্প সেচ পদ্ধতির অংশ হিসেবে ভূগর্ভস্থ নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে এখন সেচ দিতে হচ্ছে। এতে করে সেচের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সহজ ও স্বল্পমূল্যে আবার জমিতে সেচের চাহিদা পূরণের জন্য পুনরায় খালটি খননের দাবি জানিয়েছেন তিনি।











